আওয়ামীলীগ এবং চেতনা

২৪ বছরের পাকিস্তানের অবহেলা,শোষণ ও বৈষম্য থেকে বের হওয়ার জন্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ যে চেতনাকে ধারণ করে সংঘটিত হয়েছিল ,সেটি ছিল সাম্য গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সর্বোপুরি একটি ন্যায় ভিত্তিক শোষণহীন শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলা। কোনো ব্যক্তিগত মত বাদ কিংবা একক কোন ব্যক্তির নেতৃত্বের বদলে গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক একটি আদর্শিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকরা।কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই আমাদের সেই চেতনা একে একে হুঁচোট খেতে থাকে স্বয়ং শেখ মুজিব এবং তাদের দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কাছ থেকে। সেই চেতনা কে তারা প্রায় ধ্বংস করেই দিয়েছেন বলা যায়। নীচে ধারাবাহিক ভাবে তা' তুলে ধরা হলো:

0১.

যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতীয় মেজর জেনারেল ওবানের পরিচালনায় দেরাদুনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মী বিশেষ করে তোফায়েল গ্রূপের ছেলেদের নিয়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) নামে একটি বাহিনী বা মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীতে কর্মরত কম্যুনিস্ট বা প্রগতিশীল কর্মীদের হত্যা করে আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব বজায় রাখা।অথচ মুক্তি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এই দেশের সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

সূত্র: বাংলাদেশে কম্যুনিষ্ট আন্দোলন: আবু জাফর মোস্তফা সাদেক পৃ: ৫৭

0২.

বাংলাদেশ স্বাধীন করার মূল মন্ত্র বা চেতনা ছিল পাকিস্তানীদের শোষণ থেকে মুক্তি, বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য, সকলের সমান অধিকার, কথা বলার অধিকার ও গণতান্ত্রিক মতবাদের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা।  কিন্তু মুক্তি যুদ্ধের এই চেতনা প্রথম ধাক্কা খায় শেখ মুজিবের তথা আওয়ামীলীগের কাছ থেকে। তারা গণতন্ত্রের বদলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন “মুজিববাদ” অর্থাৎ মুজিবের শাসন।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী দেশে ফিরে আসার দিনই আওয়ামীলীগারা গনতন্তের বদলে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার শপথ নিলো।  ২৭ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে The New York Times এ এভাবেই প্রতিবেদনটি ছাপা হয়:

The New York Times, 1975-01-27

Thousands of voices chanted in Bengali: “A new nation has come upon the earth — Bangladesh! Bangladesh! A new ism has come to the world — Mujibism Mujibism!”

অর্থাৎ কয়েক হাজার কণ্ঠ বাংলায় উচ্চারণ করেছিল: “পৃথিবীতে একটি নতুন জাতি এসেছে – বাংলাদেশ!

বাংলাদেশ! বিশ্বে একটি নতুন “ইসম” (মতবাদ) এসেছে – মুজিববাদ, মুজিববাদ! “

0৩.

পরবর্তীতে,

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৯ দিনের মাথায় অর্থাৎ ৪ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক বিরাট সুধী সমাবেশে বক্তৃতা কালে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্ধ ঘোষণা করেন যে স্বাধীনতা সংগ্রাম “মুজিববাদ” সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে।

অথচ এই স্বাধীনতা সংগ্রাম এর মূল চেতনাই  ছিল সাম্যবাদ ও গণতন্ত্র।  কাজেই আওমীলীগ-ই মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় প্রথম আঘাত হানে। ছাত্রলীগের এই ঘোষণা পরেরদিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারী ১৯৭২ ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়।

> ০৫/০১/১৯৭২ সালে আওয়ামী ভাইয়েরা “মুজিববাদ” প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করে ছাত্র গণ-জমায়েত এর মধ্য দিয়ে । তারা আবারো দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন “মুজিববাদই এ দেশের মানুষের মুক্তির সনদ” ।  ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় ৫ ও ৬ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে তা প্রচারিত হয়

>  ০৪/০২/১৯৭২ (দৈনিক আজাদ): পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ সিলেটে জেলা আওয়ামীলীগ কর্মীদের এক সম্মেলনে ট্যাকনিকেল ইনস্টিটিউট বলেছেন জনগণের মুক্তির জন্য “মুজিববাদ” কায়েম করতেই হবে।

>  ১৩/০২/১৯৭২ (দৈনিক আজাদ): আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গণপরিষদ সদস্য জনাব আব্দুল মান্নান বলেছেন এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য দেশে অবশ্যই মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

>  ০৭/০৬/১৯৭২: শেখ মুজিব নিজেই মুজিববাদ ঘোষণা দেন

>  ০২/০৮/১৯৭২: আওয়ামীলীগের সভায় মুজিববাদ প্রতিষ্টার শপথ গ্রহণ করা হয়

‘মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে’ গড়ে উঠতে থাকলো একের পর এক বেসামরিক লাঠিয়াল বাহিনী, আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী, লাল বাহিনী এমনি বহু। আর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় এইসব উচ্ছঙ্খল বাহিনী দৌর্দন্ড প্রতাপে চালাতে থাকলো হয়রানি এবং নির্যাতন।যাকে তাকে যখন তখন দিতে থাকলো হুমকি।

সূত্র কথামালার রাজনীতি, রেজওয়ান সিদ্দিকী পৃ:৪

>  ২৭/০৯/১৯৭২: সাপ্তাহিক হক কথা, মুখপত্র ও স্পোকম্যান নিষিদ্ধ করে দিয়ে শেখ মুজিব বাক স্বাধীনতায় হানা দেন

>  ১১/০৮/১৯৭৩: চিটাগাং এ দেশ বাংলা অফিস এ তালা ও ১০ জন কে গ্রেফতার করে  শেখ মুজিব বাক স্বাধীনতায় হানা দেন

>  ০৫/০২/১৯৭৪: সংসদে বিশেষ ক্ষমতা আইন ৭৪ উপস্থাপন করে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেন শেখ মুজিব

>  ২৫/০১/১৯৭৫: শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনে। এই সংশোধনীতে বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং কেবলমাত্র আওয়ামীলীগের তোষামোদ করে এমন ৪টি পত্রিকা রেখে বাকি সকল পত্রিকা  বন্ধ করে দিয়ে মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় বিরাট আঘাত হেনেছিলেন

তাসলিমা আবেদ 

তসলিমা আবেদ ছিলেন একজন নারী অধিকার কর্মী এবং রাজনীতিবিদ।

তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংঘের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। এটি ছিল ধর্ষণের শিকার নারীদের পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করার জন্য একটি ফাউন্ডেশন। ১৯৭৪  সালে বাংলাদেশ সরকার ফাউন্ডেশনের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন নাম প্রদান করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়।

১৯৮০ সালে তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং একই বছর জুলাই মাসে কোপেনহেগেনে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের কনভেনশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ১৯২৩ সালে দিনাজপুরের ফরক্কাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে দিনাজপুর একাডেমি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং রিপন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং দিনাজপুর জেলা বারে যোগ দেন।

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী নবাবগঞ্জ কলেজ এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার প্রথম শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী এবং গণপরিষদের (বাংলাদেশের অস্থায়ী সংসদ) স্পিকার ছিলেন।  শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বাকশালের শ্রমিক লীগের চেয়ারম্যান করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে শ্রমমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ সরকারে যোগ দেন এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের (মিজান চৌধুরী অংশে) মহাসচিব ছিলেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বস্ত্রমন্ত্রী এবং ১৯৮১ সালে বিচারপতি আবদুস সাত্তার মন্ত্রিসভায় পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৮৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন এবং ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদের অধীনে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইন্তেকাল ।

আব্দুল হক 

আবদুল হক দিনাজপুর জেলার রাজনীতিবিদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে দিনাজপুর-৫ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সিরাজুল ইসলাম

সিরাজুল ইসলাম ১৯৪৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালের জুন মাসে ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে দিনাজপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাছাড়া ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পঞ্চগড়-১ আসন থেকেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সিরাজুল আলম খান একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, দার্শনিক এবং লেখক। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একটি গোপন সংগঠন, “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ” এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।   

জাসদ:

১৯৭২ সালের অগাস্ট মাসে জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে মেজর জলিল, আ.স.ম আব্দুর রব এবং শাহজাহান সিরাজ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন। শেখ মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে “গণবাহিনী” নামে জাসদের একটি বিপ্লবী সশস্ত্র বিভাগ ছিল। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে এই গণবাহিনীতে ছিলেন হাসানুল হক ইনু, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া। জাসদের প্রধান উদ্দেশ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা  করা।

বাংলাদেশ জাতীয় লীগ:

১৯৬৮ সালের ২০ জুলাই জনাব আতাউর রহমান খান বাংলাদেশ জাতীয় লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ১৯৮৪ সালে তিনিই দলটির অবসান ঘটান। জনাব আতাউর রহমান খান ছিলেন একজন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও লেখক।  তিনি  সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সাল থেকে  মার্চ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মুখ্য মন্ত্রী ছিলেন। তাছাড়া তিনি ৩০ মার্চ ১৯৮৪ সাল থেকে ৯ জুলাই ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট এরশাদ এর শাসনামলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ৮৬ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।