মুক্তি যুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি


0১.
আওয়ামীলীগ মুক্তি যুদ্ধের রণাঙ্গনের শক্তি ছিল না। তবে স্বাধীনতা নিয়ে আওয়ামীলীগের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা স্বত্বেও মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে বিধায় তাদেরকে বড়জোর মুক্তি যুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি বলে থাকেন অনেকে। কিন্তু কেউ কেউ আবার আওয়ামীলীগকে মুক্তি যুদ্ধের শুরু থেকে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত করেন। তাদের মতে, যেহেতু আয়ামীলীগাররা সরাসরি রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেনি; সেইকাৰণে তারা মুক্তিযুদ্ধকে তাদের প্রয়োজনে কেবল ব্যবহার করতে চায়। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেইভাবেই মুক্তিযুদ্ধটাকে তারা ব্যবহার করেছে। ৭০ এর নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়েছিলো সেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কর্মকান্ডে ভাগ বসাতে চায়। এটি একদম সহজ একটা অঙ্ক যে, যারা মুক্তি যুদ্ধ করেছে তাদের নাম পেতে বা তাঁরা তাদের নাম লিপিবদ্ধ করতে ৫০টি বছর লাগার কথা নয়। ৮ মার্চ ২০২২ এ দৈনিক প্রথম আলো‘র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে আওয়ামীলীগের প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ, ম রেজাউল করিম জাতীয় মুক্তিযুদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) দরখাস্ত করে মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মন্ত্রী রেজাউল করিমের জন্ম তারিখ ১৯৬২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী; সেই অনুযায়ী মুক্তি যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ৯ + বছর। ৯ + বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কতটুকু বিশ্বাস করা যায়; আর তাও তিনি জানালেন দেশ স্বাধীনতার হওয়ার ৫০ বছর পর।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালও ৫০ বছর পর বুঝতে পারলেন তিনিও মুক্তি যুদ্ধ করেছেন। তাই তিনিও জামুকাতে আবেদন করেছিলেন; যদিও তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
আওয়ামীলীগের আরেক সাবেক মন্ত্রী লেঃ কঃ ফারুক খান একজন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার। যিনি মুক্তি যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মিতে চাকরি করছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার বহু বছর পরে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। তিনিও স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আবেদন করেছেন যে, তিনি মুক্তি যুদ্ধা ছিলেন। একজন আর্মি অফিসার কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তা’ কারো অজানা থাকার কথা নয় বা তিনি নিজেও ৫০ বছর দরখাস্ত না করে বসে থাকার কথা নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তিনিও বুঝতে পারলেন তিনি যুদ্ধ করেছেন আর তাই জামুকাতে আবেদন করেছেন স্বীকৃতির জন্য। তাঁর নাম গেজেটভুক্ত হওয়ায় নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন অনেকে। সেইজন্য জামুকা সেনাসদরের মতামত নিতে চাচ্ছে।
সুত্রঃ ৮ মার্চ ২০২২, দৈনিক প্রথম আলো
জামুকার সূত্রমতে বিগত ৫০ বছরে অন্তত ৭ বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার।
তাই রণাঙ্গণের অনেক মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামীলীগকে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। যেমন ধরুন রণাঙ্গণের মুক্তিযুদ্ধা ও বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জনাব হায়দার আকবর খান রনো তাঁর এক লেখায় লিখেছেন যে, মুক্তি যুদ্ধের সময় ন্যাপ, কম্যুনিস্ট, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ইত্যাদি পরিচয় গোপন রেখে যুদ্ধে যেতে হতো। কারণ এইসব পরিচয় পেলে আওয়ামীলীগ নেতারা তাদেরকে ক্যাম্প থেকে বের করে দিতো।এর ফলে তারা কেবল যুদ্ধ করার অধিকার থেকে কেবল বঞ্চিত হতো না, তাদের গ্রেফতার হওয়া কিংবা নিহত হওয়ার আশংখা ছিল। তবুও কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার, যেমন, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল জামান সহ আরো কয়েকজন তাদেরকে সাহায্য করেছেন। এই সেক্টর কমান্ডাররা মুক্তি যুদ্ধা হিসাবে বাম কর্মীদের নিয়োগ করেছেন, এমনকি দেশের ভিতরে বাম গেরিলা ঘাঁটিগুলির জন্যও অস্ত্র সরবরাহ করেছেন।
বাম সংগঠনের কিংবা রণাঙ্গণে যারা যুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাদের সাথে কেবল কলকাতায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধা নাম ধারণ করাদের একটা পার্থক্য তো থেকেই যায়, যা’ আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য বিব্রতকর। যার কারণে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের ২৩৬৭ জন রণাঙ্গণের মুক্তি যুদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। পরবর্তীতে 0আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবি ডঃ কামাল হোসেনের একটি রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট ও আপীলেট ডিভিশন ৩ জানুয়ারী ২০১৭ সালে সেই ২৩৬৭ জন মুক্তি যুদ্ধার স্বীকৃতি বহাল রাখেন।
0২.
যারা মুক্তি যুদ্ধ করেছে তারাই তো মুক্তিযুদ্ধা। এর চাইতে সহজ সংজ্ঞা আর কি হতে পারে। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী নেতারা প্রায় সবাই কলকাতা পাড়ি দিয়েছিলেন এবং কেউ -ই মুক্তি যুদ্ধের মাঠে থেকে মুক্তি যুদ্ধ করেননি সেহেতু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রথমেই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী দেশে ফিরে আসার পর মুক্তি যুদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে লেগে গেলেন। শেখ মুজিবও যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের বাইরে যারা কলকাতা থেকে যুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে তাদেরকেও মুক্তি যুদ্ধাদের তালিকায় যুক্ত করতে বলেন। তারই অংশ হিসাবে তিনি এবং তার পরবর্তীতে সকল আওয়ামীলীগ সরকার ভারতের দেয়া তালিকা এবং “লাল মুক্তি বার্তা” কে অনুসরণ করতে বলেন। ভারতীয় তালিকা কিংবা লাল মুক্তি বার্তায় যারা যুদ্ধ না করেও কলকাতা ছিল এবং সেখানে থেকে মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে তাদের সবার নাম ছিল অর্থাৎ সকল আওয়ামী নেতারা যারা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি কেবল বুলেটের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছেন তারা সবাই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কাজেই, অনেকের অনীহা স্বত্বেও আওয়ামীলীগকে মুক্তি যুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি বলা গেলেও রণাঙ্গনের মুক্তি যুদ্ধের শক্তি বলা যাবে না।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বিনা ভোটের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পর পর দু’বার ক্ষমতায় এসে বিভিন্ন পন্থায় মুক্তি যুদ্ধের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে ভূয়া মুক্তিযুদ্ধা সংযোজন করে নেয় এবং এক পর্যায়ে প্রকৃত মুক্তি যুদ্ধাদের বিভিন্ন মুখী চাপে অনেক ভুয়া মুক্তি যুদ্ধাদের বাদ দিতে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ২৬ জুলাই ২০২১ সালে “দৈনিক প্রথম আলো” পত্রিকার ২নং পৃষ্ঠার ১ নং কলামে প্রকাশিত নরসিংদীর বাসিন্দা ৫ জন মুক্তিযুদ্ধার হাই কোর্টে রীট দায়ের নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। হাই কোর্ট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় মুক্তিযুদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন।