স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘ নয় মাসের একটি সংগ্রাম। এই সংগ্রামকে লিপিবদ্ধ করতে হলে কয়েকটি বই লিখার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা এই পোর্টালে কেবল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু থেকে ২৬শে মার্চ শহীদ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত একটি প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি মাত্র। এটির কারণ হচ্ছে পাঠকদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটা ফাউন্ডেশন তৈরী করে দেয়া, যাতে করে পাঠকরা আমাদের নয় মাসের সংগ্রামের ইতিহাস পড়তে কোনো রকম কনফিউসড না হয়ে সংক্ষিপ্ত ও স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে বিস্তারিতভাবে সঠিক বই পড়ে আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসকে জানতে পারেন।
পটভূমি
পাকিস্তানের প্রায় ৩৩০০০ সৈন্য কাশ্মিরের স্থানীয়দের বেশ ধারণ করে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে এবং এর ফলে ভারতীয় সৈন্যরাও স্থানীয় কাশ্মীরিদের সহায়তায় ১৫ই আগস্ট যুদ্ধবিরতি ফায়ার লাইন অতিক্রম করে এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে যায় । এই যুদ্ধে দু’দেশের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয় । জাতিসংঘ যুদ্ধ বিরতি জারি করায় অসমাপ্ত এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই বিজয় দাবি করে । তবে এই যুদ্ধে দু’দেশের স্থায়ী ভূখণ্ডের কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় নাই ।
তাসখন্দ চুক্তি
১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসের ৪-১০ তারিখে তৎসময়কার সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) এর প্রধানমন্ত্রী আলেকসে কোসিগিন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, দু’দেশের সৈন্যদের ৫ আগস্টের যুদ্ধ পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া, অর্থনৈতিক, শরণার্তী ও অন্যান্য প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্য তার দেশের তাসখন্দ শহরে (বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী) আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । প্রধানমন্ত্রী আলেকসে কোসিগিন এর মধ্যস্থতায় ১০ জানুয়ারী দু’দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা জন্য একটি চুক্তি সম্পাদিত হয় যা পরবর্তীতে “তাসখন্দ চুক্তি“ নাম পরিচিতি পায় ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী (যিনি পরের দিন তাসখন্দেই মারা গেছেন) এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এই চুক্তির মোটেই পক্ষে ছিলেন না । এই কারণে তিনি তার মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন যা আয়ুব সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসাবেও আত্মপ্রকাশ করে ।
ছয় দফা
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী নেতারা ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাসখন্দ পরবর্তী রাজনীতির ধারা মূল্যায়ন করার জন্য একটি জাতীয় সম্মেলনের ডাক দেন । ৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের কয়েকজন সদস্যসহ সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোর পৌঁছেছিলেন । পরের দিন ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বিষয়-কমিটির সভার আগে ছয় দফা সম্বলিত একটি বক্তব্য রাখেন এবং পরবর্তী দিনের সম্মেলনের এজেন্ডায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান কিন্তু প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায় । সেজন্য তিনি ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বয়কট করেন । তারপর ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের আগে ছয় দফার প্রস্তাব রাখা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব গৃহীত হয় ।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো যে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান আমাদের বাংলাদেশ) ঐসময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । দেশরক্ষা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জামের অভাবে ভারতের আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তানের ৩ দিনও টিকে থাকার অবস্থা ছিল না । সব কিছুতেই পূর্ব পাকিস্তান কে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়েছিল আর সেজন্য ১৭ দিনের ওই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বৈদেশিক বাণিজ্য অচল হয়ে পড়েছিল । সেইকাৰণে আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান কে দেশরক্ষা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রদেশ হিসাবে গড়ে তুলার জন্য পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ অবসানের লক্ষ্যে এই ৬ টি দফা সম্বলিত দাবিটি তিনি বিরোধী দলীয় সম্মেলনে পেশ করেছিলেন । তখন তিনি এই কথাও বলেছিলেন যে, ৬ দফার প্রশ্নে আলোচনা করা যেতে পারে ।
এই ছয়টি দফা ছিলঃ
দফা ১ | শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি: লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে। |
দফা ২ | কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ। |
দফা ৩ | মুদ্রা বা অর্থ–সম্বন্ধীয় ক্ষমতা: মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ- (ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা (খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে। |
দফা ৪ | রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা: ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে। |
দফা ৫ | বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা: (ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে। (খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে। (গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে। (ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না। (ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব- স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে। |
দফা ৬ | আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে। |
প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা ছিল পাকিস্তান ভিত্তিক বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের সনদ । সকল ঘটনা এখান থেকেই শুরু হতে থাকে । পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে কোনো বাঙালি সোচ্চার কণ্ঠ কে তখন থেকেই দাবিয়ে রাখতে থাকে ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
৬ জানুয়ারী ১৯৬৮ – ২২ ফেব্রূয়ারি ১৯৬৯
বাঙালি সোচ্চার কণ্ঠ কে দাবিয়ে রাখার অংশ হিসাবে পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারী ২ জন বাঙালি সিএসপি অফিসার সহ ২৮ জন সামরিক ও বেসামরিক অফিসার কে গ্রেফতার করে । গ্রেফতারের পর সরকারি প্রেস নোট প্রকাশ করে যাতে বলা হয় যে এই গ্রেফতারকৃত ২৮ জন ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে সশস্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তান কে আলাদা করার ষড়যন্ত্র করেছিল । একই বছর ১৭ জানুয়ারী ওই ২৮ জন অফিসার এর সাথে শেখ মুজিব কেও একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় । পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারী সরকারি প্রেস নোট এ বলা হয় যে, শেখ মুজিব ও কর্নেল এমএজি ওসমানী সহ ৩৫ জন বাঙালি ১৯৬৭ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় গিয়ে ভারতের সাথে মিশে পূর্ব পাকিস্তান কে আলাদা করার ষড়যন্ত্র করেছেন । এদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার দেখানো হয় এবং এদের সবার বিরুধ্যে যে মামলা করা হয় তার নাম দেয়া হয় State vs. Sheikh Mujibur Rahman and others বাঙালিরা যাকে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” হিসাবে অভিহিত করেছিল ।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেছিলেন যা পাকিস্তান কে বিচ্ছিন্ন করার শামিল । আসামিদের মধ্যে দু’জন, একজন নৌবাহিনীর স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান এবং অন্যজন শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ আলী রেজা একটি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের সমর্থন চাইতে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরার শহর আগরতলায় গিয়েছিলেন । এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উদঘাটন করেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুল আলম, যিনি আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা বিভাগের (আইএসআই) অধিদফতরের পূর্ব পাকিস্তান ডিটাচমেন্টের কমান্ড করেছিলেন । এই মামলায় ১১ জন কে রাজসাক্ষী করা হয়েছিল । ১৯৬৭ সালে এই পরিকল্পনার অভিযোগে সব মিলিয়ে ১৫০০ বাঙালিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র বিভাগ ঘোষণা করেছিল যে গ্রেফতারকৃতরা সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে এবং পূর্ব পাকিস্তান কে ভেঙে দেওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা সনাক্ত করেছে এবং ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে । পরে ১৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র বিভাগ শেখ মুজিবকেও জড়িত করে । তিনি এবং অন্যান্যদের ১৯৬৮ সালের ৯ ই মে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে অবশ্য শেখ মুজিব কে ছেড়ে দেওয়া হয় কারণ,পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য শেখ মুজিবকে ও ভারতের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি । কিন্তু জেল গেট থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগুতেই শেখ মুজিব কে আবার গ্রেফতার করা হয় । এর বিচারের জন্য ২১ এপ্রিল গঠন করা হয় বিশেষ ট্রাইবুনাল । বিচার শুরু করা হয় কুর্মিটোলা সেনানিবাসে ১৯ জুন । রাজসাক্ষী করা হয় ১১ জন কে । প্রকৃতপক্ষে, ওই মামলার ঘটনার সঙ্গে শেখ মুজিব কোনো ভাবেই জড়িত ছিলেন না । তিনি কখনোই পূর্ব পাকিস্তান কে আলাদা করার চিন্তা করেননি । তিনি ৬ দফার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন ।
Thomas Williams নামে একজন ব্রিটিশ আইনজীবী এবং স্থানীয় আইনজীবীরা শেখ মুজিবের পক্ষে একটি পিটিশন দায়ের করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পক্ষে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার জন্য কোনো ষড়যন্ত্র করেননি, কেবল স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফার সনদ-ই পেশ করেছিলেন সেই মোতাবেক ডিফেন্সও তৈরী করে রেখেছিলেন । কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, পাকিস্তানী পক্ষ যে ১১ জন রাজসাক্ষী প্রস্তুত করেছিল তারাও সাক্ষী বাক্সে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিল যে তারা রাজ্যের জবরদস্তিতে ভুয়া প্রমাণ সরবরাহ করেছে ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীরা
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান
জনগণ “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” টি কে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখছিল, যার জন্য বাঙালিরা এই মামলাকে সব সময় “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” হিসাবে অভিহিত করে আসছে । তারা গণআন্দোলনের আয়োজন করে তাৎক্ষণিকভাবে মামলা প্রত্যাহার এবং সমস্ত বন্দীদের মুক্তি দাবি করেছিল । সরকারী সিদ্ধান্ত অনুসারে, মামলার চূড়ান্ত তারিখ ছিল ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি । তবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণে সরকারকে তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়েছিল ।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে একজন পাকিস্তানী হাবিলদার তার জেলখানার দরজায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করে । এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পরবর্তীতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা ভাসানী আয়ুব খানের শাসনের বিরুধ্যে গর্জে উঠলেন । অতীতে তিনি প্রতিটি গণ আন্দোলে যেভাবে গর্জে উঠতেন ঠিক এইবারও তিনি চুপ করে বসে থাকতে পারলেনা না । ভাসানী কেন্টনমেন্ট ঘেরাও করার হুমকি দিলেন । তার নেতৃত্বে ঢাকায় আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকলো । উত্তেজিত জনতা যেখানে সরকারের পক্ষে প্রধান আইনজীবী এবং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান থাকতেন সেই স্টেট গেস্ট হাউস এবং অন্যান্য সরকারী ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় । তারপর প্রধান আইনজীবী এবং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান গোপনে গেস্ট হাউসটি ছেড়ে চলে যান ।
অগ্নিসংযোগের ফলে অনেক মামলার ফাইল এবং প্রমাণ পুড়ে গিয়েছিলো । তার সাথে ছাত্র সমাজ যুক্ত হয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতে থাকলো । ছাত্র সমাজ তাদের নিজস্ব সমস্যা নিয়ে ১১ দফা সম্বলিত দাবি- দাওয়া নিয়ে ভাসানীর আয়ুব বিরুধী গণ আন্দোলনে যোগ দেয় ।ঢাকায় কারফিউ চলছে দিন রাত । কিন্তু কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাজপথে ছাত্র-জনতার ঢেউ নামতে থাকলো । পাকিস্তানী মিলিটারিরা সেই রাতেই ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণ করে অসংখ্য মানুষ কে হত্যা করলো । কিন্তু বাংলার মানুষ এর পরেও একটুও বিচলিত হয় নাই । কঠিন শপথ নিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়লো তারা । গ্রেফতারকৃত শেখ মুজিব কে মুক্ত করার শপথও নিলো ছাত্র-জনতা । অধিকার আদায়ের এই কঠিন আন্দোলের মুখে আয়ুব খান বিচলিত হয়ে গেলো । এইখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারত- পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত তাসখন্দ চুক্তি সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুধী দল মেনে মেনে নেয়নি । তারাও একই সময় সিঁধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে আয়ুব বিরুধী আন্দোলন গড়ে তুলে ।
গণআন্দোলনের মুখে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে । মামলা প্রত্যাহার করে।
শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবের নেতা হওয়ার নেপথ্য
গোলটেবিল বৈঠক
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – ১৪ মার্চ ১৯৬৯
পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুধী দলের আন্দোলন ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাসানীর নেতৃত্বে গণ আন্দোলন ও ছাত্র সমাজের ১১ দফার আন্দোলকে সমন্বয় সাধন করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করলেন । এই “ডাক” এর প্রধান এবং আহ্বায়ক হিসাবে নির্বাচিত হলেন নোয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান । পশ্চিম পাকিস্তানে আয়ুব বিরুধী আন্দোলনে এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । পুরা দেশব্যাপী আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়েই আয়ুব খান পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে দেশের সার্বিক সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপায় বের কৰাৰ জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে ২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন । শেখ মুজিব, মাওলামা ভাসানী ও জুলফিকার আলী ভুট্র্রু সহ অনেক নেতাই আমন্ত্রিত হলেন গোলটেবিল বৈঠকে ।
শেখ মুজিব আয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন । তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সকল নেতাদের প্রতিশ্রতি দিলেন যে একমাত্র ছাত্র সমাজের ১১ দফার ভিত্তিতেই তিনি গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করবেনা । অন্যদিকে মাওলানা ভাসানী গোলটেবিল বৈঠক বর্জনের ঘোষণা দিলেন । কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই । তাছাড়া অবস্থার বিশ্লেষণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করা ছাড়া এ পর্যায়ে রাজনৈতিক জটিলতার অবসান ঘটানো সম্ভব নয় । তাই তিনি গোলটেবিল এ যোগ না দিয়ে পল্টন ময়দানে এক জনসভার ডাক দিলেন । পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভূট্রোও সেই বৈঠক বর্জন করার সিদ্দান্ত নেন কিন্তু শেখ মুজিব কারো কথা না শুনেই ১৬ জন সদস্য নিয়ে বৈঠকে যোগদান করেছিলেন । পাকিস্তানের দুই অংশের দুই প্রভাবশালীর নেতার অনুপস্থিতিতে ২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক বসে । প্রথম বৈঠকের পর অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায় ১০ মার্চ পর্যন্ত । ১০ মার্চের অধিবেশনে শেখ মুজিব তার ওয়াদার বরখেলাপ করলেন । ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার পরিবর্তে শেখ মুজিব তার ৬ দফার দাবি উত্তাপন করলেন । কথা ছিল ১১ দফায় হবে বৈঠকে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি -“ডাক” এর আলোচনার ভিত্তি । কিন্তু শেখ মুজিব সমঝোতার বরখেলাপ করে ৬ দফার দাবি উত্তাপন করায় নেতাদের মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি হলো । “ডাক” ভেঙে গেলো । বৈঠকে কোনো রাজনৈতিক সিদ্দান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হলো না এবং ১৪ মার্চ শেখ মুজিব এবং বৈঠকে অংশগ্রহণ করা বাঙালি সকল নেতৃবৃন্দ ঢাকায় ফিরে এলেন ।
গোলটেবিল বৈঠক ও স্বাধীনতার স্বপ্ন
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – ১৪ মার্চ ১৯৬৯স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা করেছিলেন আওয়ামী লীগ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পরবর্তীতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী । কিন্তু শেখ মুজিব কখনো পূর্ব পাকিস্তান কে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা করেননি । তিনি স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছিলেন মাত্র । পল্টনের বিশাল জনসভায় মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিব কে বৈঠকে যোগ না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন । সেইদিন তিনি বিশাল জনসভায় স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছিলেন,
“পশ্চিম পাকিস্তান, আস্সালামুআলাইকুম” অর্থাৎ পাকিস্তানের সাথে আর থাকতে চাই না, Good bye, Pakistan “পশ্চিম পাকিস্তান, আস্সালামুআলাইকুম” – এই শ্লোগান টি ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ সমাজের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । সেইদিন থেকে তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন ।
তাছাড়া, নৌবাহিনীর এক বাঙালি অফিসার, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম বাঙালিদের প্রতি বিশেষ করে বাঙালি সামরিক বাহিনীর লোকদের প্রতি অবিচার আর অবহেলার কারণে পাকিস্তানী শাসকদের প্রতি খুব-ই বিক্ষুব্দ ছিলেন । তখন থেকেই তিনি স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন । তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্ট, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর কিছু দুঃসাহসী তরুণ সদস্য এবং কয়েকজন বাঙালি আমলার সহায়তায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করেছিলেন ।
গোলটেবিল পরবর্তী রাজনীতি
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – ১৪ মার্চ ১৯৬৯
গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর পাকিস্তানের দুই অংশেই আয়ুব খান বিরুধী বিক্ষোভ তখন খুব তুঙ্গে । দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্তিতির অবনতি ঘটতে থাকলো । আয়ুব খানের ব্যাক্তিগত ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তার ধস নামতে থাকে । ১৯৬৮ সালের জানুয়ারী তে প্লুমনারি এম্বোলিজওমে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন । অসুস্থতার কারণে সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ ও ইউনিটগুলো থেকে তিনি আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন । শাসনকার্য পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন গুটিকতক জি-হুজুর টাইপ আমলার উপর । এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলেন চক্রান্তকারী ক্ষমতালিপ্সু জেনারেলগন । তাদের সাথে হাত মিলান আয়ূব খান থেকে বিচ্যুত হওয়া নবগঠিত পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং আয়ুব বিরোধী কিছু বেসামরিক আমলা ।
আয়ূব বিরোধী এই চক্রান্তের নেতৃত্ব দেন তারই নিযুক্ত সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান । ১৯৫৮ সালে জেনারেল আয়ুব খান যখন সেনা প্রধান হিসাবে জনাব ইস্কান্দর মির্জাকে সরিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করছিলেন তখন তরুণ সেনা অফিসার ইয়াহিয়া খান ছিলেন তার বিশেষ অনুগত একজন ষ্টাফ অফিসার । অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের নীল নকশা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে উঠেন তিনি । তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে জেনারেল মুসা খান সামরিক বাহিনীর প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি নেয়ার পর অনেককে সুপারসিড করে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান ইয়াহিয়া খান খানকে সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দেন ।
সার্বিক পরিস্তিতির সুযোগ নিয়ে ইয়াহিয়া খান একদিকে জেনারেলদের নিয়ে তার ক্ষমতা দখলের নীল নকশা নতুন করে তৈরী করতে গোপন বৈঠকে মিলিত হতে থাকেন; অন্যদিকে আরেক জেনারেল পীরজাদার মাধ্যমে ভুট্টোকে উৎসাহিত করতে থাকেন আয়ুব বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে তোলার জন্য । জেনারেলদের পরোক্ষ আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জনাব ভুট্টো রাজনৈতিক অঙ্গনে সরাসরি ও শক্তিশালীভাবে আত্মপ্রকাশ করেন ও আয়ুব বিরোধী আন্দোলন করে তুলতে খুব উৎসাহী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন । ওই সময় আজিজ আহমেদ নামে একজন বেসরকারি আমলা ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী । আজিজ ও তার অনুসারীরা আয়ূব বিরোধী প্রচারণা অত্যন্ত চতুরতার সাথে সরকারি আমলাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে থাকলেন । তিনি সেই প্রচারণা দিয়ে প্রশাসনের একটি অংশকে আয়ূব বিরোধ্যে ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্ষম হন।
উপরুন্ত দেশের সার্বিক পরিস্তিতির অবনতি সম্পর্কে আরেক সামরিক আমলা মেজর জেনারেল আকবরের নির্দেশে এমন সব তথ্য প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান কে জানানো হচ্ছিলো যাতে ক্রমশই তিনি আশাহীন ও দুর্বল হয়ে পড়েন । প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান আসলেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন । এহেন পরিস্তিতিতে ১৯ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে জেনারেল মুজাফ্ফর উদ্দিন কে ডেকে পাঠালেন। একটি গোপন বৈঠক হলো জেনারেলদের । বৈঠকে চীফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসান সবার পক্ষ থেকে সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে বললেন, আমরা দেশের অবস্থার অবনতি আর সহ্য করবো না । দেশের অখণ্ডতা আজ হুমকির সম্মুখীন । আয়ুব প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে অকেজো ।এ পরিস্তিতিতে আপনার নেতৃত্বে মার্শাল ল’ জারি করা ছাড়া দেশকে বাঁচানোর আর কোনো পথ নাই। আপনি যত সত্বর সম্ভব দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করুন । বৈঠকে সিদ্দান্ত নেয়া হয় ২৫ মার্চ (১৯৬৯) দেশে সামরিক আইন জারি করা হবে । গোপন এই বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান আয়ূব খান কে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে আমরা পরিস্তিতির অবনতি আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো না, ২৫ শে মার্চ এর মধ্যে আপনার যা করার করে ফেলুন । আয়ুব খান পরিস্তিতির উন্নতির জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর বদল করেন কিন্তু তাতেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হল না ।
২৪ শে মার্চ রাতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল মুজাফ্ফর উদ্দিনের সাথে মিটিং হলো এবং অনেক ফর্মেশন কমান্ডাররাও এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন । তারা মার্শাল ল’ বিষয়ে আলোচনার পর সবাই মিলে প্রেসিডেন্ট হাউস এ গেলেন । মার্শাল ল’ জারি করা হবে এবং তা সামরিক বাহিনীর লোকদের নেতৃত্বে হবে এই প্রস্তাব শুনে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান পদত্যাগের সিদ্দান্ত নেন এবং ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা প্রচার করা হলো । তার আগে ২৪ শে মার্চ রাতেই ইয়াহিয়া খান জনাব ভুট্টোর সাথে দেখা করে শর্ত সাপেক্ষে তার সমর্থন আদায় করেন । পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলো এবং ইয়াহিয়া খান হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।
দেশের সার্বিক পরিস্তিতিতে বিশেষ করে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রক্ষিতে সামরিক শাসন জারি ও সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খানে নেতৃত্ব গ্রহণে দেশবাসী খুব একটা বিস্মিত হয় নি । ক্ষমতা দখলের ২৪ ঘন্টার মধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন, ” আমার কেন রাজনৈতিক অভিলাষ নেই, আমার একমাত্র প্রচেষ্টা হবে অতি সত্বর একটি শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়া ।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি গঠনমূলক রাজনৈতিক তৎপরতা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সুষ্টু, সৎ এবং পরিচ্ছন্ন কার্যকর প্রশাসন একটি পূর্ব শর্ত । যে সমস্ত সমস্যাবলী আজ জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে সেগুলোর সমাধান রাজনীতিবিদদের-ই বের করতে হবে । ইয়াহিয়া খানের এই ভাষণের পর হঠাৎ করেই সমগ্র পাকিস্তানে সকল স্ট্রাইক ও আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলো । ছাত্র ও শিক্ষকগণ সব আন্দোলন পরিহার করে নিজ নিজ কাজে যোগদান করলেন । এভাবেই অখণ্ড পাকিস্তানের রাজনৈতিক পটে শেষ অধ্যায়ের সূচনা হলো ।
৩১ শে মার্চ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট বনে গেলেন । যুক্তি হিসাবে বলা হলো, নতুন সরকারকে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি দানের কূটনৈতিক জটিলতা দূর করার জন্যই জেনারেল ইয়াহিয়া খান কে প্রেসিডেন্ট হতে হয়েছে । প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধানরূপে বলবৎ থাকেন ।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হীন মনোভাব, বিদ্বেষ, বৈষম্যমূলক আচরণ ও বঞ্চনা জনমনে সৃষ্টি করে প্রকান্ড ক্ষোভ । এই ক্ষোভের আগুনকে প্রশমিত করতে এবং বাঙালিদের কিছুটা খুশি করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৬ জন বাঙালি সিএসপি অফিসারকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে সেক্রেটারির পদে নিয়োগ দেন । তিনি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে নির্দেশ দেন, যখনই কোন সিনিয়র পোস্ট খালি হবে সেখানে বাঙালিদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যেন নিয়োগ দেয়া হয় । তার নির্দেশে সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের জন্য নিয়োগের কোটা দ্বিগুন করা হয় । বাঙালিদের মনে পুঞ্জিবিত ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট এর প্রচেষ্টা প্রশংসিত হলেও কালের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা প্রবাহ তখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে । বাঙালি জাতি ১৯৬৯ সালে কেবল স্বাধীনতার কথাই ভাবছে । ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন ও বাঙালিদের পশ্চিমা বিরোধী ক্ষোভের একটি প্রধান কারণ ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কিছু বৈষম্য । নীচে এই বৈষম্যের কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো:
সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৩৬.২৩% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ৬৩.৭৭% ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ:
সাল | পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ (কোটি রুপিতে) |
পূর্ব পাকিস্তানে খরচ (কোটি রুপি তে) |
---|---|---|
১৯৫০-৫৫ | ১১২৯ (৬৮.৩১%) | ৫২৪ (৩১.৬৯%) |
১৯৫৫-৬০ | ১৬৫৫ (৭৫.৯৫%) | ৫২৪ (২৪.০৫%) |
১৯৬০-৬৫ | ৩৩৫৫ (৭০.৫০%) | ১৪০৪ (২৯.৫০%) |
১৯৬৫-৭০ | ৫১৯৫ (৭০.৮২%) | ২১৪১ (২৯.১৮%) |
মোট খরচ | ১১৩৩৪ (৭১.১৬%) | ৪৫৯৩ (২৮.৮৪%) |
সূত্রঃ ৪র্থ পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৭০-৭৫, volume 1) অ্যাডভাইসারি প্যানেল এর রিপোর্ট, পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত
চাকরীর ক্ষেত্রে যে বৈষম্য ছিল তা’ সামরিক বাহিনীর নীচের চিত্র থেকে অনুমেয়:
পদবী | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
---|---|---|
জেনারেল | ৩ জন | 0 |
মেজর-জেনারেল | ২০ জন | 0 |
ব্রিগেডিয়ার | ৩৪ জন | 0 |
কর্নেল | ৪৯ জন | ১ জন (বাংলা বলতেন না) |
লেঃ কর্নেল | ১৯৮ জন | ২ জন |
মেজর | ৫৯০ জন | ১০ জন |
নৌবাহিনীর | ৫৯০ জন | ১০ জন |
নৌবাহিনীর অফিসার | ৫৯৩ জন | ৭ জন |
বিমান বাহিনীর অফিসার | ৬৪০ জন | ৪০ জন |
(সূত্রঃ ১৯৫৬ সালের ডন পত্রিকার প্রতিবেদন)
এই বৈষম্য সত্ত্বেও পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল ২রা জুন, ১৯৭০ বাৎসরিক প্ল্যান (১৯৭০-৭১) চূড়ান্ত করেন কিন্তু এই প্ল্যান এর ঘোড় বিরোধিতা করেন মন্ত্রী পরিষদের ৩ জন বাঙালি, জনাব ডাব্লিউ চৌধুরী, জনাব হাফিজ উদ্দিন ও জনাব শামসুল হক। তারা বলেন, দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির আন্তরিকতা সেই বাৎসরিক প্ল্যান এ প্রতিফলিত হয়নি বিধায় এই প্ল্যান গ্রহণযোগ্য নয় । তারা ৩ জন লিখিতভাবে ইয়াহিয়া খান কে জানান যে, অতি অন্যায় ভাবে বাৎসরিক বাজেটে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৈষম্যমূলক অর্থিক বরাদ্দের প্রতিবাদে মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন । এ ধরণের অন্যায় মেনে নিয়ে তাদের পক্ষে মন্ত্রী হিসাবে কাজ করা সম্ভব নয় । যাই হোক, পরবর্তীতে ১৯৭০-৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৫০ কোটি রুপি প্রাথমিকভাবে বরাদ্ধ করা হয় এবং প্রয়োজনে আরো বরাদ্ধের জন্য আশ্বস্ত করা হয় ।
১৯৬৯-৭০ সালে পাক-ভারত সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। কারণ পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগগুলো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সরাসরিভাবে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট এর কাছে রিপোর্ট পেশ করতে থাকে । তারা প্রেসিডেন্ট কে জানায় যে, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতার আন্দোলন করার জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে ভারত ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে । প্রেসিডেন্ট কে তার একটি বন্ধু রাষ্ট্রও একই কথা বলে সতর্ক করে দেয় । কিন্তু ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সব সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছিলেন ।
তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত সফর করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা করতে লাগলেন । অতি সঙ্গত কারণেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সাথে তার আলোচনাকেই প্রাধান্য দেন । শেখ মুজিব প্রথমদিকে ইয়াহিয়ার আন্তরিকতা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেননি তবে পরবর্তী পর্যায়ে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বেশ একটি সৌহার্দপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হতে সমর্থ হন । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে অক্ষুন্ন রেখে রাজনৈতিক সমস্যাবলীর গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা । মাওলানা ভাসানীর সাথেও ইয়াহিয়া খান আলোচনা করলেন কিন্তু পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকট থেকে উত্তরণের প্রসঙ্গে পরিষ্কার তেমন কিছু আলোচনা হয়নি ।
পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দক্ষিনপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো যারা বিশেষভাবে ইসলাম প্রিয় বলে পরিচিত তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ ও আঞ্চলিক বৈষম্যতার মতো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে কোনো বক্তব্যই রাখেননি । দূরদর্শিতার অভাবে তাঁরা এই বিষয়গুলি সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন । মস্কোপন্থি অলি খান ও মুজাফ্ফর আহমেদ এর ন্যাপ ও অন্যান্য চরমপন্তি রাজনৈতিক দলগুলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে কোনোরূপ আলোচনা করতে অসম্মতি জানায় । তারা প্রথম থেকেই সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে আসছিল । অন্যদিকে জনাব ভুট্টো তখন পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে ব্যস্ত । একই সাথে অত্যন্ত চতুরতার সাথে ক্ষমতাশালী জেনারেলদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন ।
তারপর চার মাস আলাপ-আলোচনার পর ১৯৬৯ সালের ২৮ শে জুলাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর নির্ধারিত বক্তব্য পেশ করেন । তিনি বলেন, আলোচনা কালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো মূল রাজনৈতিক সমস্যাসমূহের উপর ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেন । তিনি বলেন আমাদের সর্বপ্রথম পাকিস্তানকে নিয়েই ভাবতে হবে । তার মানে এই নয় যে, ন্যায় সঙ্গত আঞ্চলিক দাবিগুলো উপেক্ষিত হবে । অখণ্ডতার প্রতি হুমকি নয় এমন সব দাবিগুলো পূরণের সব উপায় বের করতে হবে । এরপর বাঙালিদের দাবি-দাওয়া ও আক্রোশ সম্পর্কে প্রেসিডেন্টে বলেন, জাতীয় পরিসরে বাঙালিরা তাদের ন্যায় সঙ্গত দায়িত্ব পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে । এই বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ক্ষোভ থাকা খুব স্বাভাবিক । প্রতিজ্ঞা করছি এইসব অন্যায়ের প্রতিকার আমি করবো । পাকিস্তানের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্র প্রধান এর আগে এত খোলাখুলিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে এইভাবে দেখেননি । পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক দাবীসমূহের উল্লেখযোগ্য ইসু ছিল সাধারণ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন ধার্য্য করা । কিন্তু এর মধ্যে ২৮ শে নভেম্বর ১৯৬৯ ও ৩০ শে মার্চ ১৯৭০ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কে ভুট্টো ও কিছু সংকীর্ণমনা জেনারেল এবং বেসামরিক আমলাদের একটি অংশ থেকে ভীষণ চাপের সম্মুখীন হতে হয় । তারা দাবি তুলেন লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার (LFO) এ স্বায়ত্ত শাসনের পরিধি পরিষ্কার করে দিতে হবে প্রেসিডেন্টকে । এতে করে বাঙালিরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি উত্তাপন করতে পারবে না । এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান গভর্ণর আহসানের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, স্বায়ত্তশাসনের পূর্ণ অধিকার ও গণভোটের অধিকারের কোন ব্যতিক্রম হলে আলোচনার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে । ৬ দফার ব্যপারে প্রেসিডেন্ট কে দেওয়া শেখ মুজিবের প্রতিশ্রুতিই ছিল তার বিশ্বাসের ভিত্তি । শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট কে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখার জন্য ৬ দফার দাবিতে তিনি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করবেন ।
ইতিমধ্যে একটি ঘটনা ঘটে গেলো । শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারী তে জনাব জি ডাব্লিউ চৌধুরীর সাথে আলোচনা করার সময় বলেন যে, LFO (লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার) এর আওতায় প্রাদেশিক নির্বাচনও হয়ে যাওয়া উচিত । যুক্তি হিসাবে শেখ মুজিব বলেন ৬ দফার দাবিতে আপোষ করে পরবর্তীতে প্রাদেশিক নির্বাচনে যাওয়া তার জন্য কঠিন হবে । জনাব ভুট্টো শেখ মুজিবের অভিমত সমর্থন করেন এবং একই সাথে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক নির্বাচনের পক্ষে মত দেন । এ থেকেও পরিষ্কার বুঝা যায় শেখ মুজিব একান্তভাবে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে চান নি । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জনাব জি ডাব্লিউ চৌধুরীর কাছ থেকে শেখ মুজিব ও ভুট্টোর মত জানার পর কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন একই সাথে করার জন্য সিদ্দান্ত নেন । সেজন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩১ শে মার্চ ১৯৭০ জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচন নিয়ে ৪ টি নীতির কথা বলেন:
(১) ইসলামিক আদর্শই হবে পাকিস্তানের ভিত্তি । শেখ মুজিব এর বিরোধিতা করেননি, বরং তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা ছিল, “আওয়ামীলীগ নির্বাচিত সংসদ দ্বারা এমন কোনো সংবিধান তৈরী করতে দিবে না যার মাধ্যমে কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশ করা যায় । জাতীর কাছে ওয়ামীলীগ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
(২) দেশে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন করার সাপেক্ষে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে । কেউই এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি। শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে নিশ্চিত করতে হবে । শেখ মুজিব এর বিরোধিতা করেননি ।
(৩) পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় বিধিসমূহ শাসনতন্ত্রের অংশ হিসাবে পরিগণিত হবে । কেউই এর বিরোধিতা করেননি ।
(৪) কেন্দ্র-প্রাদেশিক সম্পর্ক এমন হবে যে, প্রদেশগুলো পূর্ণ স্বায়ত্তশাহনের অধিকার লাভ করবে । শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর তার ড্রাফট প্রেসিডেন্ট কে দেখাতে হবে । ড্রাফটের কোন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এর ব্যাখ্যা কিংবা মন্তব্য চূড়ান্তভাবে শাসনতন্তের গৃহীত হবে ।
৭০ এর নির্বাচন
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – ১৪ মার্চ ১৯৬৯
এরপর ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭০ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ১৪ এপ্রিল ঢাকা ত্যাগ করার সময় অনেক কিছুই বলে যান তবে এও বলেন যে, এবার গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানীরা শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করবে না, তারা জাতীয় পরিসরে দেশকে শাসন করার নায্য অধিকারও লাভ করবে । ৩১ মার্চ, ১৯৭০ ঘোষণা করা হয় যে, LFO (লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার) এর অধীনে সরাসরি ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালে ৩০০ আসনের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্টিত হবে । তারপরপরই রাজনৈতিক কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয় এবং ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে পূর্ণ মাত্রায় রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় । সব রাজনৈতিক দল জোর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দেন । এক নির্বাচনী জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে টিকে থাকার জন্যই, কোনো শক্তিই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না ।”
নির্বাচনী প্রচারণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পরিস্তিতি কিছুটা ঘোলাটে হয়ে যায় । শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ৬ দফা ও স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের সব জায়গায় নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালান । ১৯৭০ সালের ১৪ই আগস্ট ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের একটি পতাকা তৈরী করে আকাশে উড়িয়ে দেয় । ওই মিটিং এ সভাপতিত্ব করছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির তৎকালীন ভাইস চ্যাঞ্চেলর জনাব আবু সায়ীদ চৌধুরী । তাকে জোনাল মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল ইয়াকুব খান ডেকে পাঠান এবং পতাকা’র ঘটনা সম্পর্কে কৈফিয়ত দাবি করেন । গভর্ণর আহসানের সহায়তায় জনাব চৌধুরী সে যাত্রায় রক্ষা পান ।
এদিকে অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা থেকে খোলাখুলিভাবে “এপার বাংলা ওপার বাংলা” নামক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা শুরু করে দেয় । গোয়েন্দা বিভাগীয় রিপোর্ট এ বলা হয় আওয়ামীলীগকে নির্বাচনে জিতানোর জন্য এবং প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোকাবেলা করার জন্য ভারত থেকে বিপুল পরিমান অর্থ ও অস্ত্র দুটোই পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে । পাকিস্তানের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগগুলোই শুধু নয়, কয়েকটি বন্ধু রাষ্ট্রের তরফ থেকেও একই ইঙ্গিত পাওয়া যায় । নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ তখন কিছুটা ঘোলাটে হয়ে উঠেছে ।
এ অবস্থায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেলো পূর্ব পাকিস্তানে । ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে হল এক ভীষণ বন্যা এবং নভেম্বরে হলো এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণি ঝড় । তাই মাওলানা ভাসানী ও ভুট্টো নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানালেন । তাঁরা দুজন একসাথে ঘোষণা দিলেন, “ভোটের আগে ভাত চাই” . কিন্তু শেখ মুজিব নির্বাচন পিছানোর বিরোধিতা করলেন । তার এই বিরোধিতায় প্রেসিডেন্ট যথাসময়ে নির্বাচন করার সিদ্দান্তে অটল থাকলেন । প্রেসিডেন্ট আশা করেছিলেন তাঁর এই সিদ্দান্তে শেখ মুজিব খুশি হবে, হয়েছিলেনও ঠিক তাই । শেখ মুজিব খুশি হয়ে প্রেসিডেন্ট কে গোপন সূত্রে তাঁর আগের ওয়াদার পুনরাবৃত্তি করে খবর পাঠান যে, পাকিস্তানের ঐক্য তিনি টিকিয়ে রাখবেন অবশ্যই । প্রেসিডেন্ট মুজিবের ওয়াদায় পূর্ণ আস্তা স্থাপন করেছিলেন।
১৯৭০ এর নভেম্বর/ডিসেম্বর এর প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় । বৈঠকে শেখ মুজিব প্রতিজ্ঞা করেন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার পর সংসদে উত্তাপনের আগে তিনি সেটা প্রেসিডেন্ট কে দেখাবেন তাঁর সম্মতির জন্য । তিনি প্রেসিডেন্ট কে বলেন, ৬ দফা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য প্রণীত হয়নি । তিনি আরো বলেছিলেন, তাঁর ৬ দফা ও প্রেসিডেন্ট এর বর্ণিত LFO (লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার) তে বর্ণিত ৫ নীতির উপর ভিত্তি করেই তিনি তৈরী করবেন দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র । শেখ মুজিবের সাথে তিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করার পর প্রেসিডেন্ট এর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে, সাধারণ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্টিত করার সিদ্দান্ত সঠিক এবং একমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমেই পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব ।
১৯৭০ এর নির্বাচনে মোট ২৪টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে । সরকারি হিসাবে ভোটার উপস্তিতি ছিল ৬৩% । পুরা পাকিস্তানে ভোটার সংখ্যা ছিল ৫৬৯৪১৫০০ এবং এর মধ্যে ৩১২১১২২০ জন ভোটার ছিল পূর্ব পাকিস্তানে এবং ২৫৭৩০২৮০ জন ভোটার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে । নীম্নে প্রাপ্ত ভোট ও পার্টি অনুযায়ী প্রাপ্ত সীটের সংখ্যা উল্লেখ করা হলো:
পার্টি | প্রাপ্ত ভোট | শতকরা হার (%) | প্রাপ্ত আসন সংখ্যা |
---|---|---|---|
আওয়ামী লীগ | ১২৯৩৭১৬২ | ৩৯.২০ | ১৬০ |
পিপিপি | ৬১৪৮৯২৩ | ১৮.৬০ | ৮১ |
জামাত-এ-ইসলামী | ১৯৬৫৬৮৯ | ৬.০০ | ৪ |
কাউন্সিল মুসলীম লীগ | ১৯৬৫৬৮৯ | ৬.০০ | ৭ |
মুসলিম লীগ (কায়ুম) | ১৪৭৩৭৪৯ | ৪.৫০ | ৯ |
জামিয়াতে উলামায়ে ইসলাম | ১৩১৫০৭১ | ৪.০০ | ৭ |
জামিয়াতে উলামায়ে পাকিস্তান | ১২৯৯৮৫৮ | ৩.৯০ | ৭ |
কনভেনশন মুসলি লীগ | ১১০২৮১৫ | ৩.৩০ | ২ |
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি | ৮০১৩৫৫ | ২.৪০ | ৬ |
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি | ৭৩৭৯৫৮ | ২.২০ | ১ |
অন্যান্য পার্টি | ৩৮৭৯১৯ | ১.২০ | ০ |
স্বতন্ত্র | ২৩২২৩৪১ | ৭.০০ | ১৬ |
মোট | ৩৩০০৪০৬৫ | ১০০.০০ | ৩০০ |
পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টা তেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে । বাকি বাকী দুজন ছিলেন নুরুল আমিন ও চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারেনি । আওয়ামী লীগের মতো পূর্ব পাকিস্তানেও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দল কোন আসন লাভ করতে পারেনি । ফলে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের এবং ভুট্টো হয়ে উঠেন পশ্চিম পাকিস্তানের মূল নেতা ।
নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার পর পর-ই শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলী ভূট্টো কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অভিনন্দন জানান এবং তিনি সকল রাজবন্দীদের বিনা শর্তে মুক্তি দেন । প্রেসিডেন্ট চাচ্ছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে শেখ মুজিব ও ভুট্টোর সাথে আলোচনা শুরু করতে । সেই মোতাবেক তিনি ১৯৭১ সালের ১২ই জানুয়ারী তিনি ঢাকায় আগমন করেন এবং ঐদিনই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । তাদের এই বৈঠক হয়েছিল প্রায় ৩ ঘন্ঠা ব্যাপী ।
এই আলোচনায় নির্বাচনের পূর্বে একমত হওয়া অর্থাৎ পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্ট কে দেখাতে শেখ মুজিব অস্বীকার করেন । শেখ মুজিব তখন প্রেসিডেন্ট কে দেয়া তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন । শেখ মুজিবের এই ধরণের মনোভাবের ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভীষণভাবে মর্মাহত হন ।
১২ই জানুয়ারীর বৈঠক বিপর্যয়ের পর মন্ত্রী সভার সদস্য জনাব হাফিজ উদ্দিন শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেছিলেন । সেই সময় জনাব তাজ উদ্দিনও (আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি-জেনারেল) উপস্থিত ছিলেন । জনাব হাফিজ উদ্দিন শেখ সাহেব কে তাঁর দেয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট কে তাদের প্রণীত খসড়া শাসনতন্ত্র দেখাবার অনুরোধ জানান । শেখ মুজিব তখন হাফিজ উদ্দিন কে পরিষ্কার করে কিছু বলেননি তবে তাজ উদ্দিন সাহেব পরিষ্কার ভাষায় বললেন যে, শেখ মুজিব এমন কোন কথা কাউকে দেন নি । শাসনতন্ত্রের খসড়া কাউকে দেখাবার দায়ভারও আওয়ামী লীগের নেই । এ ধরণের দাবি নেহায়ত -ই যুক্তিহীন।
তারপর ২৭ জানুয়ারী জনাব ভুট্টো শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন । ভুট্টো ও মুজিব তিন দফা শেখ মুজিবের বাসভবনে মিলিত হয়েও পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন । যাই হউক, অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৩ ই ফেব্রূয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দেন যে, ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে ।
জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্টের ঐঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করে বলেন যে, তাঁর ও শেখ মুজিবের মধ্যে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র নিয়ে কোন সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসতে পারে না । তিঁনি হুমকি দিয়ে বলেন তাঁর দাবি অবহেলিত হলে করাচি থেকে খাইবার পর্যন্ত বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে । জনাব ভুট্টো ভালো করেই জানতেন জান্তার বেশিরভাগ জেনারেল তাঁর পক্ষে রয়েছেন । ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর জান্তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট এর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে ।
ক্ষমতাহীন প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর বিরোধিতার মুখে ১লা মার্চ এক ঘোষণায় ৩রা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করতে বাধ্য হন । জাতীয় সংসদ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার সংবাদ শোনার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পরে । সেদিনই বিক্ষুব্ধ বাঙালীর হৃদয়ে বাংলাদেশের জন্ম হলো । বিকাল সাড়ে ৪ টার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার জনতা পল্টন ময়দানে সমবেত হয় কিন্তু তখনও শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীগন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আলোচনা করছিলেন । ইতিমধ্যে পূর্বাণী হোটেলের বাইরের প্রাঙ্গনটি আক্রোশে ফেটে পড়া জনতার সমাগম বাড়তে থাকলো । তারা পাকিস্তানী পতাকা পুড়তে থাকলেন । ছাত্র নেতারা মাঝে মধ্যে উঠে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখছিলেন । জনতার আক্রোশ নাগালের বাইরে যেতে চলছিল । শেখ মুজিব তখন হোটেলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন । তাঁকে বার বার স্বাধীনতার ঘোষণার আহ্বান জানালেও তিনি তা মেনে নেননি এবং জনতার আহ্বান এড়িয়ে গিয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন যে, ২রা মার্চ ঢাকায় ও পরদিন সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট পালিত হবে । তিনি জনতাকে এও বললেন যে, ৭মার্চ রেস্ কোর্স ময়দানে ভাষণ দিবেন এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন । সেই রাতে ঢাকা শহরের সর্বত্র বিক্ষুব্ধ জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হলে পূর্বাঞ্চলীয় সেনানিবাসের প্রধান কর্মকর্তাবৃন্ধ ঘটনা মূল্যায়ন করে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং সেই কারণে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ১২ ঘন্টার সান্ধ্য আইন জারি করা হলো । আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হলো । ঢাকা শহরে সর্বত্র সান্ধ্য আইন লঙ্গিত হলো । টহলরত সেনাবাহিনীর সদস্যরা আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুলি চালালো এবং এতে বেশ কয়জন মারা গেলো । নিরস্র জনতা খালি হাতেই সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হলো । বাঙালীরা এবার তাদের সাহস ও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা দেখাতে থাকলো । শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে Non Co-Opetation Movement বা অসহযোগ কর্মসূচী ঘোষণা করেন । ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন শেখ মুজিবের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে । পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত কেন্দ্রের সাথে সব সম্পর্কই প্রায় ছিন্ন হয়ে যায় । এই অবস্থার মধ্যেও মুজিব-ইয়াহিয়া যোগাযোগ অব্যাহত থাকে ।
ছাত্রদের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – ১৪ মার্চ ১৯৬৯২রা মার্চ বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ.স. ম আব্দুর রব বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন । এই পতাকা উত্তোলনের জন্য শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দ কে তিরস্কার করেছিলেন । ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় তৎসময়কার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন । এ সভায় ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, সভা শেষে শেখ মুজিব মিছিলের নেতৃত্ব দিবেন । কিন্তু শেষ মুহূর্তে বক্তৃতার এক পর্যায়ে স্বয়ং শেখ মুজিব মিছিলের কর্মসূচি বাতিল করেন । অত্যন্ত চতুর যুক্তি দিয়ে কারণ হিসাবে তিনি তৎকালীন পুলিশের আইজি তসলিমুদ্দিন সাহেবের বরাত দিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দকে বলেন, তার কাছে গোয়েন্দা বিভাগের খবর রয়েছে মিছিলে যোগদান করলে সামরিক শাসকগোষ্ঠী তাঁকে মেরে ফেলবে । সেই কারণে সেইদিন ২রা মার্চ তিনি মিছিলের নেতৃত্ব না দিয়ে ৩রা মার্চ প্রদেশব্যাপী সাধারণ হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন ।
অবশেষে স্বাধীনতার ঘোষণা
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – ১৪ মার্চ ১৯৬৯
ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিক্ষোভের জোয়ার লেগেছে । ওই রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামে আগত এম ভি সোয়াত থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ নামাতে চেষ্টা করলে মারাত্মক গন্ডগোল লেগে যায় । ডক শ্রমিকরা এই সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে দিলো এতে হাজার হাজার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও নাবিকদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লো । এই গন্ডগোল নতুন রূপ ধারণ করলো যখন পূর্ব পাকিস্তানের বিডিআর এর একটি ইউনিট বাঙালী বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালাতে অসীকার করলো । জানা গেলো ৭ জনকে কোর্ট মার্শাল দেয়া হয়েছে এবং পরবর্তীকালে তাদেরকে গুলি করে মারা হয়েছে । এই ঘটনা বাঙালীদের বিক্ষোভের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দিলো ।
৩রা মার্চ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ২টা পর্যন্ত অবিরাম হরতাল পালনের নির্দেশ দেওয়ার কারণে প্রতিদিন ওই সময়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি অফিস, আদালত ও ব্যাংকের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো । এমনকি ডাক ও তার, বিমান, ট্রেন পর্যন্ত অচল হয়ে পড়লো । ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর ও অন্যান্য সেনানিবাসে রেশনের স্বল্পতার জন্য সৈন্যদের সরিয়ে নেয়া হলো । এমন পরিস্তিতিতে আকস্মিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া লেঃ জেঃ টিক্কা খান কে নিযুক্ত করলেন ।
৭ই মার্চের জনসভার প্রাক্ষালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে দীর্ঘ সৌহার্দপূর্ণ আলাপ করেন । দু’জনই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভুত সমস্যার সমাধানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিব কে সতর্ক করে দিয়ে অনুরোধ করেন যাতে মুজিব এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন যেখান থেকে ফেরা অসম্ভব হয়ে পরে । শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টকে এই ব্যাপারে আশস্ত করেছিলেন যে তিনি দ্যায়িত্বশীল আচরণ করবেন তবে প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় এসে বিস্ফোরোন্মুখ অবস্থা স্বচক্ষে দেখে যাবার আমন্ত্রণ জানান। ৭ই মার্চ শেখ মুজিব ঐতিহাসিক জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি । তিনি প্রেসিডেন ইয়াহিয়ার কাছে ৪টি দাবি উপস্থাপন করেন:
(১) অবিলম্বে মার্শাল’ল উঠিয়ে নিতে হবে
(২) আর্মি কে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে ।
(৩) আর্মি অ্যাকশন এর ফলে যে প্রাণহানি ঘটেছে তার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্তা করতে হবে ।
(৪) অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ।
এ দাবিসমূহ পূরণ না হওয়া পর্যন্ত Non Co-operation Movement বা অসহযোগ আন্দোলন চলবে । আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান জনাব এয়ার ভাইস-মার্শাল এ. কে. খন্দকার বীর উত্তম তাঁর “ভেতরে বাইরে” বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, শেখ মুজিব পরিশেষে জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন । এভাবেই ৩রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্যারালাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ।
ইতিমধ্যে একটি ভারতীয় বিমান হাইজ্যাক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত সরকার ভারতের উপর দিয়ে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় । পাকিস্তানের ক্রান্তিলগ্নে ভারত সরকারের এ ধরণের চরম সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য পাকিস্তান তার বন্ধু রাষ্ট্র আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) কে মধ্যস্থতা করার জন্য অনুরুধ জানায় । জাতিসংঘের মহাসচিব মধ্যস্থতা করার জন্য সম্মতি জানান কিন্তু ভারত সরকার মহাসচিবের এই সিদ্ধান্তের চরম বিরোধিতা করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। পরবর্তীকালে বিচার বিভাগীয় তদন্তে জানা যায় হাইজ্যাকাররা সবাই ছিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে গৃহীত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য । শেখ মুজিব ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা কে সমর্থন করে বলেন, হাইজ্যাক ঘটনা পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর না করার একটি কূট কৌশল ছাড়া আর কিছু নয় ।
পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাধীনতার আকাঙ্খা একদিকে তীব্র হতে থাকে আর অন্যদিকে শেখ মুজিব অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হতে থাকলেন । ছোট খাটো রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ যখন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো শেখ মুজিব তখন ইউনিয়নে-ইউনিয়নে, মহল্লায়-মহল্লায় আওয়ামীলীগ গঠন করে তাদের খতম করার আহ্বান জানান । তিনি তাদের কে রাতের চোর বলে আখ্যায়িত করে বলেন,
“চোরের মতো রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করিয়া বিপ্লব হয় না । বিপ্লব চোরের কাজ নয় “
শেখ মুজিব তাদের কে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে আরো বলেন, “সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদের দালালদের খতম করার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে বাঁশের লাঠি ও সুন্দরী কাঠের লাঠি বানাতে হবে । প্রত্যেকের হাতে আমি না হয় বাঁশের; নয় সুন্দরী কাঠের লাঠি দেখিতে চাই ।” এই ঘটনাটা ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশ করে পত্রিকাটি আরো বলে যে, দেশের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরুপ করে শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক বিজয়কে সুসংহত করার স্বার্থে সন্ত্রাসবাদী দালালদের বাড়াবাড়ি দমনের জন্য দেশবাসীকে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ।
তাছাড়া, ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী বর্তমান সোহরাওয়ার্দী ময়দানে আওয়ামীলীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান স্বয়ং শেখ মুজিব । এই শপথের শেষ বাক্যটি ছিল, “জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান।” এইটিও ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । পত্রিকাটি বলেছিলো যে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রতি তাঁর আনুগত্য অক্ষুন্ন রেখেছেন ।
যাই হোক, এভাবেই ৩রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্যারালাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । তারপর এলো সেই কাল রাত, “অপারেশন সার্চ লাইট।” বিদ্রোহ উন্মুখ পূর্ব পাকিস্তানের অশান্ত পরিবেশে শেখ মুজিবুর রহমান তখনো অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থেকে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে পাকিস্তানে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাচ্ছিলেন। তৎসময়কার সকল নেতৃবৃন্ধই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে থাকলো কি এক অজানা কারণে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে তিনি পাকিস্তানীদের কাছে আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানীদের সাথে আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর এমনকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যখন পাকিস্তানের বিমানে চড়ে করাচি রওনা দিচ্ছেন তখনো শেখ মুজিব মীমাংসার আস্তা পোষণ করছিলেন। তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিকদের এমনও বলেছেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে আমরা একটা মতৈক্যে পৌঁছেছি।
সে যাই হোক, সেই কাল রাত অর্থাৎ ২৫ মার্চ মধ্যরাতের অনেক পূর্বেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী একজন ক্যাপ্টেন এর নেতৃত্বে ধানমন্ডিস্থ ৩২নং সড়কের বাড়ীতে ঢুকে পরে। পাজামার উপর তামাটে লাল রঙের গাউন পরিহিত শেখ মুজিব সিঁড়ি বেয়ে নীচে আসলে তারা তাঁকে একটি গাড়ীতে করে নিয়ে চলে গেলো। তার পর পরই পাকিস্তানী আর্মিরা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর হেড কোয়ার্টার পিলখানায়, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকস, খিলগাঁও আনসার হেড কোয়ার্টার্স, ঢাকা উনিভার্সিটি, পুরান ঢাকার শংকরী পট্টি ও টান বাজার এলাকায় গণহত্যা চালিয়ে হাজারো হাজার নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে রাস্তায় ফেলে রাখে এবং গণকবর দেয়।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত তৎসময়কার মেজর (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমান এর কাছে মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী ক্যাপ্টেন অলি আহমদের (পরে মন্ত্রী ও বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য) কাছ থেকে এক বার্তা নিয়ে আসলেন । তিনি তখন রাস্তায় হাটছিলেন। মেজর খালেক একটু দূরে নিয়ে গিয়ে মেজর জিয়াকে কানে কানে বললো সেনাবাহিনীর পাকিস্তানী অফিসাররা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালীকে ওরা হত্যা করেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি তখন বলে উঠলেন, “উই রিভোল্ট।” – আমরা বিদ্রাহ করলাম। এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুর ঘাটের বেতার কেন্দ্র দখল করে নেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সারা বাংলাদেশে এই ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আর নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ প্রাণ আর ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি আমাদের মহান স্বাধীনতা এবং বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সারভৌম একটি বাংলাদেশের।