দেশ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া

খালেদা খানম (ডাকনাম: পুতুল) ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা) অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মা-বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তিনি চা ব্যবসায়ী মরহুম জনাব ইস্কান্দার আলী মজুমদারের মেয়ে। তার মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন একজন গৃহিনী।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তারা দিনাজপুর শহরে (বর্তমানে বাংলাদেশে) চলে আসেন। খালেদা জিয়া প্রথমে দিনাজপুর মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরে ১৯৬০ সালে দিনাজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। একই বছরে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে তিনি “খালেদা জিয়া” বা “বেগম খালেদা জিয়া” নাম ধারণ করেন ।

তিনি ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন তারপর তিনি তার স্বামীর সাথে বসবাস করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি চলে যান। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে তারা করাচি থেকে ঢাকায় চলে আসেন। 

জিয়াউর রহমানের পদায়নের পর তাঁরা চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় চলে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেফাজতে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দী ছিলেন।

খালেদা জিয়ার প্রথম পুত্র তারেক রহমান বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান । তাঁর দ্বিতীয় পুত্র, আরাফাত রহমান (কোকো) ২০১৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালেশিয়াতে মারা যান।

তাঁর প্রথম বোন, খুরশিদ জাহান হক বিএনপি’র ২০০১ – ২০০৬ সময়কালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আর দ্বিতীয় বোন সেলিনা ইসলাম হচ্ছেন একজন গৃহিণী । তাঁর ছোট ভাই, মেজর সাঈদ ইস্কান্দার ২০০১ – ২০০৬ সময়কালে ফেনী-১আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ভাই শামীম ইস্কান্দার বাংলাদেশ বিমানের অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

১৯৮১ সালের ৩০ মে খালেদা জিয়ার স্বামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ২ জানুয়ারী ১৯৮২ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সদস্য হয়ে সক্রীয় রাজনীতিতে জড়িত হন।১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি দলটির ভাইস-চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব নেন এবং বিচারপতি সাত্তার ছিলেন চেয়ারম্যান ।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে বেগম খালেদা জিয়া এর প্রথম দিন থেকেই সামরিক স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করে আসছিলেন এবং অত্যন্ত আপোষহীন অবস্থানের অধিকারী ছিলেন। জেনারেল এরশাদের পুলিশ বাহিনী দ্বারা তিনি বার বার নির্যাতিত হয়েছেন এমনকি বন্দীও হয়েছেন।

 তাঁর সক্রিয় নেতৃত্বে বিএনপি ১২ আগস্ট ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের ছয়টি দলের সাথে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করে এবং ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটি ‘৭ দলীয় জোট’ গঠন করেন । এই জোটের প্রধান নেত্রী হিসাবে তিনি আপোষহীনভাবে ৯টি বছর জেনারেল এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশবাসী তাঁকে “আপোষহীন নেত্রী” উপাধিতে ভূষিত করে। স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৩ জানুয়ারী ১৯৮৪ সালে বিএনপি প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং বেগম খালেদা জিয়া তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৮৪ সালের মে মাসে তিনি কাউন্সিলরদের দ্বারা  বিএনপি’র একটি কাউন্সিলে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

দলীয় প্রধানের পদ গ্রহণের পর এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বেগম খালেদা জিয়া। ৯ বছরের লড়াই সংগ্রাম শেষে ১৯৯০ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে সেই নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করে।  

তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী । তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি তিন তিনবার (১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁকে তিনবারই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়ীত্ব প্রদান করে। তিনি এই পর্যন্ত কখনোই কোনো নির্বাচনে পরাজিত হন নি। তাঁর অংশ নেওয়া সকল নির্বাচনেই তিনি তিনটি করে আসনে জয়লাভ করেন।

তাসলিমা আবেদ 

তসলিমা আবেদ ছিলেন একজন নারী অধিকার কর্মী এবং রাজনীতিবিদ।

তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংঘের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। এটি ছিল ধর্ষণের শিকার নারীদের পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করার জন্য একটি ফাউন্ডেশন। ১৯৭৪  সালে বাংলাদেশ সরকার ফাউন্ডেশনের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন নাম প্রদান করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়।

১৯৮০ সালে তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং একই বছর জুলাই মাসে কোপেনহেগেনে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের কনভেনশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ১৯২৩ সালে দিনাজপুরের ফরক্কাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে দিনাজপুর একাডেমি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং রিপন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং দিনাজপুর জেলা বারে যোগ দেন।

মোহাম্মদ ইউসুফ আলী নবাবগঞ্জ কলেজ এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার প্রথম শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী এবং গণপরিষদের (বাংলাদেশের অস্থায়ী সংসদ) স্পিকার ছিলেন।  শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বাকশালের শ্রমিক লীগের চেয়ারম্যান করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে শ্রমমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ সরকারে যোগ দেন এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের (মিজান চৌধুরী অংশে) মহাসচিব ছিলেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বস্ত্রমন্ত্রী এবং ১৯৮১ সালে বিচারপতি আবদুস সাত্তার মন্ত্রিসভায় পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৮৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন এবং ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদের অধীনে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইন্তেকাল ।

আব্দুল হক 

আবদুল হক দিনাজপুর জেলার রাজনীতিবিদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে দিনাজপুর-৫ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সিরাজুল ইসলাম

সিরাজুল ইসলাম ১৯৪৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালের জুন মাসে ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে দিনাজপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাছাড়া ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পঞ্চগড়-১ আসন থেকেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সিরাজুল আলম খান একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, দার্শনিক এবং লেখক। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একটি গোপন সংগঠন, “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ” এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।   

জাসদ:

১৯৭২ সালের অগাস্ট মাসে জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে মেজর জলিল, আ.স.ম আব্দুর রব এবং শাহজাহান সিরাজ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন। শেখ মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে “গণবাহিনী” নামে জাসদের একটি বিপ্লবী সশস্ত্র বিভাগ ছিল। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে এই গণবাহিনীতে ছিলেন হাসানুল হক ইনু, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া। জাসদের প্রধান উদ্দেশ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা  করা।

বাংলাদেশ জাতীয় লীগ:

১৯৬৮ সালের ২০ জুলাই জনাব আতাউর রহমান খান বাংলাদেশ জাতীয় লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ১৯৮৪ সালে তিনিই দলটির অবসান ঘটান। জনাব আতাউর রহমান খান ছিলেন একজন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও লেখক।  তিনি  সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সাল থেকে  মার্চ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মুখ্য মন্ত্রী ছিলেন। তাছাড়া তিনি ৩০ মার্চ ১৯৮৪ সাল থেকে ৯ জুলাই ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট এরশাদ এর শাসনামলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ৮৬ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।